
স্টাফ রিপোর্টার
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের বাকস্বাধীনতা খর্ব করার চক্রান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ২২২০ জন বিশিষ্ট নাগরিক বিবৃতি প্রদান করেছেন। সোমবার (২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫) এ বিবৃতি দেন তারা।
বিবৃতিতে বলা হয়, “আমরা দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, আইইউবি-র শিক্ষক ড. মোহাম্মাদ সরোয়ার হোসেনের ব্যক্তিগত ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে একটি সংগঠিত অপপ্রচার চালানো হচ্ছে এবং বিষয়টিকে বিকৃত করে এমন অভিযোগ আনা হয়েছে, যা বাস্তবতার সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ।”
“ড. মোহাম্মাদ সরোয়ার হোসেন একজন সুপরিচিত গবেষক, লেখক ও সমাজসেবক। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কিছু অবহেলিত রোগ (থ্যালাসেমিয়া, ডেঙ্গু, শিশুদের স্থূলতা ইত্যাদি) নিয়ে গবেষণা ও সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন। একজন সুনাগরিক এবং একাডেমিক হিসেবে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে তার ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ করে থাকেন। তার সব মতের সাথে সবাইকে একমত হতে হবে—এমন কোনো দাবি তিনি করেন না। তাঁর মতের সাথে ভিন্নমত থাকলে সেটি প্রকাশের একমাত্র সঠিক উপায় হলো একাডেমিক আলোচনা ও ভিন্ন গবেষণা প্রকাশের মাধ্যমে তার প্রতিবাদ করা। কিন্তু তার মতের জবাব একাডেমিক পরিসরে না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ওপর বাইরে থেকে চাপ প্রয়োগ করে তাঁর মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করা এবং শাস্তির দাবি তোলা অত্যন্ত অযৌক্তিক, অশোভন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী।”
তারা বলেন, “আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই—যে দুটি পোস্ট নিয়ে এত আলোচনা- ভুল বোঝাবুঝির জন্ম দিতে পারে মনে করে তিনি আগেই স্বেচ্ছায় সেগুলো মুছে দিয়েছিলেন এবং অনিচ্ছাকৃতভাবে কাউকে আহত করে থাকলে সেজন্য প্রকাশ্যে দুঃখও প্রকাশ করেছেন। একজন শিক্ষক ও গবেষকের কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যাশা করা যায় না। তবুও সেই মুছে দেওয়া ও ক্ষমা প্রার্থিত পোস্টকে কেন্দ্র করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি প্রকৃতপক্ষে এক ধরনের অবিচার ও ষড়যন্ত্রের অংশ। ড. মোহাম্মাদ সরোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে যাদের নাম প্রকাশ করা হয়েছে সেটা থেকে এই ষড়যন্ত্রের পেছনে এনজিও সংশ্লিষ্টতা সহজেই অনুমান করা যায়।”
“আমরা জোর দিয়ে বলতে চাই, ড. মোহাম্মাদ সরোয়ার হোসেনকে নারীবিদ্বেষী প্রমাণের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক মিথ্যাচার ও বিকৃত তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। একাধিক বিবৃতিতে তাঁকে এমন মত ও অবস্থানের সাথে জড়িত করা হয়েছে যা তিনি কখনোই প্রকাশ করেননি—যেমন বাল্যবিবাহের পক্ষে বক্তব্য দেওয়া বা নারীর স্বাস্থ্যসচেতনতার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া। বস্তুত যিনি নিজেই একজন জনস্বাস্থ্য গবেষক এবং এক্টিভিস্ট। তিনি কীভাবে নারীর স্বাস্থ্যসচেতনতার বিরোধী হবেন? তবে তিনি স্বাস্থ্যসচেতনতার নামে বিভিন্ন এনজিও ও তাদের প্রতিষ্ঠানসমূহ ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ-পরিপন্থী যে বিকৃত সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে চাচ্ছে তার বিরোধী। যেমন কেক কেটে মেয়েদের প্রথম মাসিককে সেলিব্রেট করা, ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে ছোট ছোট শিশুদের হাতে স্যানিটারি ন্যাপকিন ধরিয়ে দিয়ে ‘মাসিক’ ‘মাসিক’ এর লজ্জা ভাঙ্গানোর জিকির করানো ইত্যাদি।”
তারা আরো বলেন, “ড. মোহাম্মাদ সরোয়ার হোসেনের ব্যক্তিগত ফেসবুক প্রোফাইলে স্পষ্টভাবে লেখা আছে: “Academic researcher & writer. My views are personal and do not represent any organizations.” তাহলে কীভাবে তাঁর ব্যক্তিগত মতামতকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়া যায়? কীভাবে তাঁর প্রতিষ্ঠানের কাছে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা যায়? এটি তাঁর মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করা এবং একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর অযাচিত ও অনৈতিক চাপ প্রয়োগের সামিল। উল্লেখ্য ইতোপূর্বে ট্রান্সজেন্ডার ইস্যুতেও ড. মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেনেকে চাকুরি থেকে অব্যাহতি প্রদানের জন্য এনজিওসহ বিভিন্ন মহল থেকে আইইউবি-র ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল, কিন্তু সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনের মুখে সে চক্রান্ত সফল হয়নি।”
২২২০ জন বিশিষ্ট নাগরিকের বিবৃতিতে আরো বলা হয়, “বিভিন্ন এনজিও ও পশ্চিমা এজেন্ডা বাস্তবায়নকারী সংস্থা কর্তৃক প্রাইভেট ভার্সিটির ওপর চাপ প্রয়োগের অপসংস্কৃতির অবসান হওয়া জরুরী। ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ একাডেমিক পরিসরে থাকতে হবে। প্রশাসনিক শাস্তির ভয় দেখিয়ে ব্যক্তিগত মতামতকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করার সুযোগ কোন সভ্য দেশে থাকা উচিত নয়। আমরা ড. মোহাম্মাদ সরোয়ার হোসেনের প্রতি পূর্ণ সংহতি জানাচ্ছি এবং আইইউবি প্রশাসনকে জনমতকে উপেক্ষা করে ষড়যন্ত্রমূলক প্রচারণা ও অনৈতিক চাপের সামনে মাথা নত করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করার ঘৃণ্য চক্রান্তে পা না দেবার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি।”
বিবৃতিপ্রদানকারী ২২২০ জন বিশিষ্ট নাগরিকের মাঝে রয়েছেন ৩৬৩ জন শিক্ষক, ২৪১ জন ইঞ্জিনিয়ার, ৭৫ জন ডাক্তার এবং সাবেক সচিব ও গবেষক সহ অন্যান্য পেশাজীবীরা। বিবৃতি প্রদানকারীদের মাঝে নারী রয়েছেন ৫১৭ জন। শিক্ষকদের মাঝে ৪৮ জন অধ্যাপক, ১০ জন সহযোগী অধ্যাপক এবং ২৭ জন সহকারী অধ্যাপক রয়েছেন।
বিবৃতি প্রদানকারীদের মাঝে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এবং সাবেক পিএসসি সদস্য ড. হাসানুজ্জামান চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী এবং ইসলামিক স্টাডিজের অধ্যাপক ড. মো. মাসুদ আলম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোছা. রাশেদা চৌধুরী এবং ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহবুব মোর্শেদ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. তারেক মুহাম্মদ তওফিকুর রহমান।
বিশিষ্ট আলেমদের মধ্যে আছেন বায়তুশ শরফ ইসলামী গবেষণা কেন্দ্র ঢাকার পরিচালক ড. মাওলানা ঈসা শাহেদী, জাতীয় ওলামা মাশায়েখ আইম্মা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মুফতি রেজাউল করিম আবরার, পয়ামে ইনসানিয়াত বাংলাদেশের আমির ড. মাওলানা শহীদুল ইসলাম ফারুকী এবং টিভি উপস্থাপক মাওলানা গাজী সানাউল্লাহ রাহমানী। বিবৃতিতে আরো স্বাক্ষর করেছেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব ড. খন্দকার রাশেদুল হক, সাবেক সচিব জনাব মাহবুবুল হক, সাবেক অতিরিক্ত সচিব জনাব মহিউদ্দিন আল ফারুক, সাবেক সচিব জনাব নুরুল আলম, মূল্যবোধ আন্দোলনের সমন্বয়ক মুহসিনুদ্দীন মাহমূদ, ডাক্তার মিলিভা মোজাফফর, ডাক্তার ইরতিফা তাসনীম এবং ডাক্তার মো. আরিফ মোর্শেদ খান।